Disqus Shortname

Friday, December 11, 2015

শীতের সকাল গ্রামে ও শহরে



বিশেষ প্রতিবেদনঃ হেমন্তের দিনগুলো শেষ না হতেই শীতবুড়ি এসে জবরদখল করে নেয় বাংলাদেশের প্রকৃতি। কুয়াশা কন্যারাও নির্জন বন, মাঠ আর নদীর কূলজুড়ে ছাউনি ফেলতে শুরু করে। ক্যালেন্ডারের পাতায় তখনও চুপচাপ ঝিমায় অগ্রহায়ণের শেষের দিনগুলো। উত্তর দিগন্তে হিমালয়ের বরফচূড়া থেকে ছড়িয়ে পড়ে শীতবুড়ির হিম শীতল নিঃশ্বাস। ধরণি হঠাত্ হয়ে পড়ে জড়সড়। বিবর্ণ হলুদ পাতারা চুপিসারে খসে পড়ে পথের ধুলায়।
শীতের দীর্ঘ রাত্রির কুয়াশার আবরণ গায়ে মেখে সুবহে সাদিকে ভেসে আসে আজানের ধ্বনি। তখন গাছে গাছে পাখিদের কলকাকলীতে ঘুম ভাঙে মানুষের। ঠাণ্ডা পানিতে অজু করে নামাজে দাঁড়ায় বড়রা। ছোটরা লেপের নিচে দাদা-দাদীর গা-ঘেঁষে গল্প করে, ছড়া কাটে মিষ্টি সুরে।

শীতের ভোরে পাখির ডাকে
ঘুম ভেঙে যায় যখন,
লেপের তলায় ছড়া কাটার
ধুম লেগে যায় তখন।

শীতের সকালগুলো সত্যি বড় বিচিত্র-মন ভোলানো। কৃষকরা সেই সকাল বেলা শীত উপেক্ষা করে লাঙ্গল-গরু নিয়ে ছোটে মাঠের দিকে। বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে গেলেই তারা হারিয়ে যায় কুয়াশার মধ্যে, গাছিরা খেজুর গাছ থেকে পেড়ে আনে রসের হাঁড়ি। গাছতলাতেই গাছের মালিকের সঙ্গে ভাগাভাগি করে রস। তারপর ভাগের রস বাঁকে করে ছোটে বাড়ির পথে। সেই সকালেই রস জ্বাল দিয়ে তারা তৈরি করে গুড় আর পাটালি।
পূর্ব আকাশে কুয়াশাঢাকা সূর্যের ম্লান মুখ। মরা রোদে উঠোনে পাটি বিছিয়ে ছেলেমেয়েরা কাঁচা রসে চুমুক দিয়ে কাঁপে থরথরিয়ে। তবু খেজুরের কাঁচা রস তাদের চাই-ই চাই। কোনো মা আবার সেই ভোরবেলা ওঠে ভাপা পিঠা তৈরি করে লেপ-কাঁথার নিচ থেকে ডেকে তোলেন তাদের ছেলেমেয়েদের। গরম পিঠার লোভে ছেলেমেয়েরাও হৈ হৈ করে ওঠে পড়ে বিছানা থেকে।
বাড়ির আঙিনায়, মাচার ওপর, খড়ের চালে শিশির ভেজা শিম, বরবটি, লাউ আর কুমড়ার গাছগুলো কী অপরূপ দেখায় শীতের সকালে। মাঠভরা সরিষার হলুদ ফুল মন কেড়ে নেয় প্রতিটি মানুষের। মটরশুঁটি আর সবুজ ঘাসের ডগায় ঝুলে থাকে শিশির বিন্দু। তেতে ওঠা একটুখানি মিষ্টি রোদে তা যেন মুক্তা হয়ে জ্বলে। তারপর ঝরে পড়ে মাটির কোলে।
গ্রামে যারা বাস করে বলতে গেলে তারা প্রায় সবাই গরিব। শীতের সকালেও খালি পায়ে থাকে অনেকে। শীত নিবারণের জন্য তেমন কোনো গরম কাপড়ও তাদের নেই। যে কারণে শীতের সকালে প্রতিটি বাড়ির আঙিনাতেই ছোট-বড় সবাই মিলে খড়কুটা জ্বালিয়ে শরীর থেকে শীত তাড়াতে দেখা যায়। তবু শীতের সকালটা দুর্লভ এক মজার মতোই মনে হয় সবার কাছে।
সকাল বেলা কুয়াশার আড়াল দিয়ে সূর্যটা বেশ উপরে ওঠে আসার পরও মনে হয় ওটা যেন বড় কোনো পাখির ডিমের কুসুম। তখনও বিল-ঝিলে, দূর দেশ থেকে উড়ে আসা অতিথি পাখিদের পানির ওপর ঝাঁপাঝাঁপি, খেলাধুলা চোখে পড়ে। নানান রঙের নানান আকারের অতিথি পাখি দেখে বাংলার মানুষের মন আনন্দে ভরে ওঠে। সূর্যের তাপ একটু বাড়তেই ওরা উড়ে চলে যায় বনে—গাছের ডালে। আর বাঁধাকপির সবুজ শহরের শীতের সকাল গ্রামের মতো নয়। এখানে সকালের মিষ্টি আলো ফোটার আগেই কাকের কাকা রবে শহরবাসীর ঘুম ভাঙে। তবু লেপের নিচে মিষ্টি উত্তাপে আবার ডুবে যায় গভীর ঘুমে। যদিও এখানে গ্রামের মতো শীত এত তীব্র নয়। শহরে কল-কারখানা, গ্যাসের চুলা আর অতিরিক্ত ঘন বসতির কারণে এখানকার মানুষ বুঝতেই পারে না হাড় কাঁপানো শীতের কি যন্ত্রণা। তবু বস্তি, ফুটপাত আর রেল স্টেশনের খোলা জায়গায় সেসব মানুষ ঘুমায়, তারা ঠক্ ঠক্ করে কাঁপতে থাকে। তাই তো সকালে সূর্যের তাপ তাদের শরীরের হিম কুয়াশা চুষে না নেয়া পর্যন্ত তারা জাগতে পারে না। কেউ আবার জেগে ওঠে ছেঁড়া কাগজ জ্বেলে আগুন পোহায়।
শীতের সময় যেন পোশাকের প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায় শহরবাসীর মধ্যে। ঘুম থেকে ওঠে তারা নাশতা খেয়ে, এক কাপ চা পান করে দিনের কাজ শুরু করে। ছেলেমেয়েরা স্কুল-কলেজে যায়। সকালে শহরের অলিগলিতে দেখা যায় ভ্যান বোঝাই টাটকা শীতের সবজি। ছোট-বড় মাছও নিয়ে আসে মাছ ব্যবসায়ীরা। গ্রামের মতো এখন শহরেও দেখা যায় সকাল-বিকাল বেলা রাস্তার মোড়ে মোড়ে চিতই আর ভাপা পিঠা তৈরি করছে কেউ কেউ। বিক্রিও হয় প্রচুর। শহর এলাকাতেও অতিথি পাখিদের আগমন ঘটে থাকে প্রতি বছর। মিরপুর চিড়িয়াখানার লেকে এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের ঝিলে অগণিত অতিথি পাখির কিচিরমিচির শব্দে মুখর হয় গোটা এলাকা। শহরবাসী পরিবার পরিজন নিয়ে কাক ডাকা ভোরে পাখি দেখতে চলে যায় ঝিল আর লেকের ধারে।
সবচেয়ে মজার ব্যাপার এই যে, সকাল বেলা কুয়াশার আবরণে যখন একটু দূরের বাড়ি-ঘর, মাঠ, শহরের রাস্তা ঢাকা পড়ে থাকে তখন গাড়ির হেডলাইটগুলোও ছানিপড়া চোখের মতো দেখায়। আর শীতের সকালের রূপ হয়ে যায় অন্য সব ঋতুর থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। গ্রামের ধোঁয়া ওড়া নদীতে মাঝি সকাল বেলা ধীরে ধীরে বৈঠা ফেলে হিমশীতল পানিতে। বড় বড় নদীতে লঞ্চ-স্টিমার চালকরা কুয়াশার মধ্যে দিক ভুল করে বসে। পাইলটও ঝুঁকি নিতে চায় না আকাশে উড়তে। পৌষ আর মাঘের সকাল ছাড়া প্রকৃতির এমন রূপ আর কখনও দেখা যায় না। দেখা যায় না দূর দেশের সেসব বিচিত্র পাখিদের। যে পাখি এ সবুজ বাংলাকে ভালোবেসে অনেক কষ্টে প্রতি বছর একবার উড়ে আসে এখানে।
শীতের কুয়াশা আর শিশির বিন্দুর কথা বলতে গেলেই মনে পড়ে যায় বিশ্ব কবির সেই কটি লাইন—
বহু দিন ধরে বহু ক্রোশ দূরে—
বহু ব্যয় করি বহু দেশ ঘুরে—
দেখিতে গিয়েছি পর্বতমালা,
দেখিতে গিয়েছি সিন্ধু।
দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া
ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া
একটি ধানের শীষের উপরে
একটি শিশির বিন্দু।
তাই বুঝি শীতের সকাল দাগ কেটে যায় প্রতিটি মানুষের বুকের মধ্যে। আবার অপেক্ষায় বছর গড়ায়, নানান সাজে সাজা শীতের এমন মধুর সকালের জন্য।
Share:

পুরাতন সংবাদ

Definition List

Unordered List

Support